বুলবুলের প্রভাবে পেটে টান
বুলবুলের ঝোড় হাওয়ার দাপটে সবকিছু লণ্ডভণ্ড। উড়ে আসা টিনে পা খানিকটা কেটে গেলেও সেই পা নিয়েই উড়ে যাওয়া ঘর মেরামত করছেন বাবলু পাত্র। আর ঘর বলতে তো নামমাত্র। বালিয়াড়ির উপর গোটা কতক বাঁশ পুঁতে তার উপর পলিথিনের চাল। পলিথিনের দেওয়াল। আশপাশে এমন কয়েকটা ঘর উল্টানো ছাতার মতো পড়ে আছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে মেছো জাল, আকাশিরঙা ড্রাম, পোড়া মাটির চাকতি।
বাবলু বলেন, ‘‘ভাগ্যিস সময় মতো ঘর ছেড়েছিলাম। নয়তো মেয়ে-বৌকে নিয়ে মরতে হত।’’
বর্ষা ধরে এলে স্ত্রী আর ছোট মেয়েটিকে নিয়ে গ্রাম (কচুবেড়িয়া) ছাড়েন বাবলু পাত্র। আস্তানা গড়েন সাগরদ্বীপের কপিলমুনি মন্দিরের অদূরে ঝাউবনের কাছে মেছো ভেড়িতে। এ সময় শুকা (শুঁটকি) তৈরির মরসুম। কাঁচা মাছ বেছে আলাদা করেন বাবলু। বুলবুল যে মারাত্মক হতে চলেছে উত্তাল সমুদ্র আর ‘খর’ বাতাস দেখে আঁচ করেছিলেন তিনি। কাছেই শ্বশুরবাড়ি। রাতে সেখানে চলে যান।
তিনি জানান, ঘূর্ণাবর্তের জন্য দু’দিন ট্রলারে মাছ ধরতে যায়নি। বুলবুলে লন্ডভন্ড মাছের ভেড়ি। তছনছ হয়ে গিয়েছে কালো পলিথিনে ঢাকা অস্থায়ী ঘরগুলি। ট্রলার ফের সমুদ্রে নামতে আরও দিন দুই লাগবে। তত দিন কোনও কাজ নেই বাবলুর। তিনি বলেন, ‘‘সারা দিন কাজ করলে তবে টাকা মেলে। বুলবুলের কারণে চার-পাঁচ দিন কাজ বন্ধ। দেখি আবার কবে ট্রলার নামে।’’
ভেড়িতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জন্য রান্না করে সামান্য পারিশ্রমিক পান বাবলুর স্ত্রী নন্দিনী। মাছ বাছাইয়ের কাজেও হাত লাগান। তিনি বলেন, ‘‘লোকজন সব বাড়ি চলে গিয়েছে। সবাই ফিরতে ফিরতে আরও দিন দুই। তত দিন কোনও কাজ নেই।’’
বাড়ি সংলগ্ন ছোলা-মটরের দোকান সুরজিৎ গুড়িয়ার। ঝড়ে দোকানঘর যে ভাঙছে তা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। ওই ঝড়েই ছেলে সৌমেনকে নিয়ে দোকান থেকে জিনিসপত্র সরান। তবে সবটা সরাতে পারেননি। যদি দোকান চাপা পড়েন সেই ভয়ে। রুদ্রনগর গ্রামের বাসিন্দা সৌমেন বলেন, ‘‘যেমন ঝড়, তেমনই বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে সুচ হয়ে বিঁধছিল।’’ সৌমেন জানান, সকালে দেখেন ধানজমিতে উড়ে এসে পড়েছে পড়শির টিনের চাল। তাঁদের মেসবাড়ির উপড়ে পড়েছে বড় গাছ। রাস্তায় উপড়ে পড়েছে গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি। তিনি বলেন, ‘‘এমনিতেই দু’দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। ফের কবে আসবে জানি না। ব্যাটারি বাঁচাতে কথা সেরে মোবাইল বন্ধ করে রাখছি।’’
পরিবারের সবাইকে ‘ফ্লাড সেন্টার-’এ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা শুকদেব নাথ। বাড়িতে ছিলেন তিনি ও তাঁর ছেলে। তিনি জানান, ঝড়ে বাড়ির চাল উড়ে যায়-যায় অবস্থা। ঘর বাঁচাতে কড়িকাঠে দড়ি গলিয়ে তা ধরে মাটি কামড়ে বসেছিলেন বাপ-ছেলে। এক ঘরে থেকেও ঝড়ের শব্দে একে অন্যের কথা শুনতে পারছিলেন না। তিনি বলেন, ‘‘ঝড় এক সময় এতটাই বেড়ে গেল যে, ভয়ে বুক শুকিয়ে গিয়েছিল। ভাবছিলাম, কেন ফ্লাড সেন্টারে চলে গেলাম না।’’
সারা রাত চোখের পাতা এক করতে পারেননি কশতলা গ্রামের শুভেন্দু দাস। ভোরের আলো ফুটতে ছুটে গিয়েছেন পান বরজে। দেখেন, কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকলেও বরজের ভেতরে সব পানগাছ ধরাশায়ী। গাছের সঙ্গে বাঁধা পলকা পাটকাঠি ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। কাদায় লুটোচ্ছে পানগাছ। তিনি বলেন, ‘‘শীতে পানের দাম বাড়ে। তাই বরজে পান মজুত করে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন যা অবস্থা, গাছ বাঁচানোই দায়। বড় ক্ষতি হয়ে গেল।’’