দেশজুড়ে বিজেপি–আরএসএসের তথাকথিত দেশভক্তদের উল্লাসে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী মানুষরা দিশেহারা । তবে আশার আলো হিসাবে দেখা দিয়েছে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভার ফলাফল । সাধারন মানুষ যে আরএসএস –বিজেপির কথিত দেশভক্তির চেয়ে রুটি–রুজির দিকে বেশি নজর দিতে চাইছে তার সংকেত হল এই নির্বাচনের ফলাফল । কিন্ত তা সত্ত্বে বলা যাবে না গেরুয়াপন্থীদের দাপট কমে গেছে , বরং বলা যেতে পারে তারা হোঁচট খেয়েছে মাত্র । তাদের আদর্শ ও নীতি এখনও জারি রয়েছে । কীভাবে এল হিন্দুত্বের শ্লোগান নিয়ে দেশের রাজনীতিতে আরএসএসের দাপট ? এর নেপথ্যে কোন কোন রাজনৈতিক দল গোপনে বা প্রকাশ্যে বিজেপিকে মদত দিয়েছে । আরএসএস–বিজেপির শিকড় কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে প্রবেশ করল তা নিয়ে কলম ধরেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ , রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারন সম্পাদক ড. আবদুস সাত্তার । বাংলার জনরব নিউজ পোর্টালে তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে । আজ তৃতীয় কিস্তি । প্রকাশিত অংশের পর …
ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনায় এ-ও উদ্ভাসিত হয় যে , স্বদেশী জাগরণ – আন্দোলনের দিনগুলিতে দেশোদ্ধারে ব্রতী অনেক যুবক –তরুন সাহসী যোদ্ধা ‘ মায়ের সন্তান ‘ দেশকে ‘ মাতা ‘ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারতেন না । এই ভাবনায় , বোধে ‘ মাতা ‘ শুধু মাতা হিসাবেই নয় , দেবী , স্বয়ং দুর্গা , ‘ দশপ্রহরণধারিনী ‘-রূপে চিত্রিত হয়েছেন । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর ‘ আমার দুর্গোৎসব ‘ প্রবন্ধে কমলাকান্তের বোধে তা ‘ সুবর্ণময়ী বঙ্গ প্রতিমা’র রূপ ধারন করেছেন । বলা যায় , ‘ বন্দেমাতরম ‘ সঙ্গীতে সেই প্রতিমারই অধিকতর উদ্ভাসন । আবার এই সঙ্গীতের ভাষা সংস্কৃতের সংস্পর্শযুক্ত হওয়ায় শুধু বাংলায় নয় , সর্বভারতীয় রূপলাভেও সমর্থ হয়েছে । শুধু তাই নয় , সমাস বহুল শব্দের ব্যবহার , তার গাম্ভীর্য , পৌরুষ-দীপ্ত স্বর ও সুরের প্রক্ষেপন সর্বোপরি বিদ্রোহ ও যুদ্ধ মনস্কতার অনুষঙ্গজনিত কারণে ‘ বন্দেমাতরম ‘ গান ভারতবাসীর প্রাণে ও হৃদয়তন্ত্রীতে মন্ত্রোচ্চারণ হয়ে উঠেছে। হৃদয়ের নাভিমূলে প্রোথিত এই মন্ত্রোচ্চারণেই এই সংগীতের এক অসামান্য আবেদন, জনপ্রিয়তা । আর কে না জানে , এই মন্ত্রোচ্চারণে শূদ্রের নয় , ব্রাম্ভণের –ই কেবল একচ্ছত্র প্রতাপ , অধিকার । এই ভাবনা-চারণেরই কার্যকর রূপ বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী দেশমাতৃকার চরণশুদ্ধ রাজনৈতিক পথ প্রবাহে শিরায় শিরায় বহমান থেকেছে – কখনো জনসভায় , কখনো মিছিলে কিংবা ফাঁসির মঞ্চে । এমন –কী জীবনের প্রারম্ভিক পর্বে রবীন্দ্রনাথও এই প্রভাব –বলয় থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সমর্থ হননি । এই রণধ্বনির স্ফূরণ ‘ আনন্দমঠ’ প্রকাশিত হওয়ার চার বছর পর ১৮৮৬ সালে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে পরিলক্ষিত হয়েছে । দশ বছর পর কংগ্রেসেরই অন্য এক অধিবেশনে কবিগুরু ‘ বন্দেমাতরম ‘ –এর প্রথম দুই স্তবক সুরারোপিত করে গেয়েছেন ।
বঙ্গভঙ্গ , বঙ্গ ব্যবচ্ছেদের বিরুদ্ধে ‘ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ‘ তে জারিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ পূর্বোক্ত ধারণাকৃত ‘ বন্দেমাতরম-এর ভাবনা থেকে সরে এসেছেন । পরবর্তীকালে ‘ বন্দেমাতরম ‘-কে কংগ্রেস প্রস্তাবিত জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা-দানেও তাঁর অনীহাও কি তিনি ব্যক্ত করেন ? কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু গানটির ব্যবহারযোগ্যতা সম্পর্কে তাঁর মতামত জানতে চাইলে প্রত্যুত্তরে তিনি লিখেছেন :
‘ বঙ্কিম এই গানে বাংলাদেশের সঙ্গে দূর্গাকে একাত্ম করে দেখিয়েছেন , কিন্ত স্বদেশের এই দশভুজা মূর্তিরূপের যে পূজা সে কোনো মুসলমান স্বীকার করে নিতে পারে না । —– বাংলাদেশের একজন মুসলমানের মধ্যে যখন অযথা গোঁড়ামির জেদ দেখতে পাই তখন সেটা আমাদের পক্ষে অসহ্য হয় । তাদের অনুকরণ করে আমরাও যখন অন্যায় আবদার নিয়ে জেদ ধরি তখন সেটা আমাদের পক্ষে লজ্জার বিষয় হয়ে ওঠে । —– উভয় পক্ষেই ক্ষোভ যেখানে প্রবল সেখানে অপক্ষপাত বিচারের প্রয়োজন আছে । রাষ্ট্রীয় সাধানায় আমাদের শান্তি চাই , ঐক্য চাই , শুভবুদ্ধি চাই – কোনো এক পক্ষের জিদকে দুর্দম করে হারজিতের অন্তহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাই নে ।’ ( ১৯৩৭ সালের ৭ অক্টোবর সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি। )
‘ বন্দেমাতরম ‘ গান ‘ আনন্দমঠ ‘ উপন্যাসের অংশ যুক্ত হওয়ার কারণে মুসলিম মধ্যবিত্তের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে । উপন্যাসটি ‘ মুসলিম বিদ্বেষে’র অভিযোগে তিরবিদ্ধ হয়েছে । রবীন্দ্র-অনুমানেরই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই আরো সহজ ভাষায় ‘ আল এসলাম ‘ পত্রিকায় –
‘ বাঙ্গালা দেশে সপ্তকোটি লোকের বাস । তাহার মধ্যে অর্ধাধিক মুসলমান । এই যে বিশাল বাঙ্গালি জাতি , যাহার মধ্যে হিন্দু মুসলমান দুইটি আছে , তাহাদের জন্য যে জাতীয় সঙ্গীত রচিত হইয়াছে , তাহা হইতে মুসলমান বাদ পড়িল কেন ? ‘
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ,গানে সাত কোটি বাঙালি ও চৌদ্দ কোটি বাহুর কথা উল্লেখ থাকলেও মুসলমানকে মুসলমান হিসাবে চিত্রিত না –করে দেবীর পূজারি হিসাবে উপস্থিত করা হয়েছে । এইখানেই মুসলিম মানসের বিরূপতা । বিরূপতা জন্ম দিয়েছে দূরত্বের। দূরত্ব জন্ম দিয়েছে বিদ্বেষের । মাতৃবন্দনার রণধ্বনির প্রতিক্রিয়ায় জন্ম হয়েছে ‘ আল্লাহু আকবর ‘ ধ্বনির । স্বভাবতই বাড়বাড়ান্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার , নষ্ট হয়েছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মানবিক পরিবেশ । ফলশ্রূতিতে একে অপরের দ্বন্দ্ব –বিদ্বেষে হিংসায় মত্ত হয়ে উঠেছে । সেই কারণেই কবিগুরু তাঁর সত্তর বৎসর-পূর্তি উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বাণীতে ‘ বন্দেমাতরম ‘-এর পরিবর্তে ‘বন্দেভ্রাতরম ‘-এর স্লোগান দিয়েছিলেন কিন্ত দেশের মানুষ তা কার্যকর করেননি । রবীন্দ্র-কৃত ‘ বন্দেভ্রাতরম ‘ স্লোগান কার্যকর না হলেও , সেই লক্ষ্যেই আবার ‘ জয় বাংলা ‘ , ‘ সোনার বাঙ্গালা ‘ , সুভাষচন্দ্র বসুর ‘ কদম কদম বাড়ায়ে যা ‘ , নজরুলের ‘ চল চল চল ‘ গানেরও জন্ম হয়েছে । ‘ জয় হিন্দ ‘ সম্ভাষণরীতিও এই লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যেই নিবেদিত ।
মাতৃবন্দনাজাত দেশভক্তির বিষয়টি বাংলার সংস্কৃতিতে গম্ভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে । বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্কনে মাতা প্রতিমায় পর্যবসিত হয়ে ‘ বঙ্গমাতা ‘ –রূপে স্বদেশী পত্রিকায় ব্যবহৃত হয়েছেন। ১৯০৫ সালে ‘ বঙ্গমাতা ‘ আবার ‘ ভারতমাতা ‘ বেশে দেশবাসীর সামনে হাজির হয়েছেন । শেষ পর্যন্ত ‘ দেবী’র রূপ ধারন করেছেন যা মুসলিম মধ্যবিত্তের মননে বিরূপতার জন্ম দিয়েছে ।
দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদের সাম্প্রদায়িক রূপান্তরণে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি ‘ আপনাতে আপনি ‘ ভাবের দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ায় মুসলিমদের বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে গেছে । কে না জানে উনিশ শতকের শেষ পর্বে সমিতি ও মেলার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী ভাবনার প্রথম সচেতন প্রকাশ লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে । রাজনারায়ণ বসু’র অণুপ্রেরণায় নিবেদিত প্রাণ নবগোপাল মিত্র ওরফে ‘ ন্যাশনাল মিত্র ‘( অভিধা ) ‘ চৈত্র মেলা ‘, ‘ জাতীয় মেলা’কে শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বর্ষে ‘ হিন্দু মেলা ‘য় রূপান্তরিত করেছেন । রাজনারায়ন বসু নিজে ‘ ব্রাম্ভ ‘ হলেও হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের প্রত্যয় ব্যক্ত করতেন । তাঁর বিশ্বাসী প্রত্যয়ে ভারতবর্ষ নানা জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত হলেও ঐক্যের প্রধান যোগসূত্র হবে হিন্দু ধর্ম । তারই প্রতিফলন ‘ বৃদ্ধ হিন্দুর আশা ‘ নামাঙ্কিত গ্রন্থে । তাঁর প্রস্তাবিত ‘ মহা হিন্দু সমিতি ‘ নামক সংগঠনে মুসলমানদের কোনো স্থান হবে না এবং ‘ বন্দেমাতরম ‘ হবে জাতীয় সঙ্গীত । এই শ্রেণি কি নিজের সীমানা নিজেরাই নির্দিষ্ট করে নেয়নি ?