সাতজনকে মন্ত্রী , প্রতিমন্ত্রী করা হলেও কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে , মাত্র একজন ছাড়া কারও নাকি কোনও কার্যকর ভূমিকা নেই । চারজনের কাছে নাকি কোনও সরকারি ফাইল যায় না । গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলিতে আরএসএস-এর মহামান্যরা ঠাঁই পেলেও মুসলিমরা পায় না। সংখ্যালঘু মুসলিমরা যে ‍তিমিরে ছিলেন ,সেই তিমিরেই নিমজ্জিত হয়ে আছে

Paramanik Akash
তৃণমূল সরকার যাই বলুক বাস্তব কিন্ত আবদুস সাত্তারের মতামতেই উঠে এসেছে । মমতা সরকার যতই দাবি করুক সংখ্যালঘু উন্নয়নে তারা দেশের সেরা, বাস্তবে সংখ্যালঘু উন্নয়নে স্তোকবাক্য ছাড়া আর কিছুই করেনি তৃণমূল সরকার। সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি হয়েছে , বাস্তবমুখী কোনো কর্মসূচি নেওয়া হয়নি । রাজ্যের সাধারন মানুষের কাছে সংখ্যালঘু উন্নয়ন এই সরকার কেমন করেছে তা যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ পৌছে দেওয়ার লক্ষ্যে ড. আবদুস সাত্তারের লেখা সবার পিছে , সবার নীচে সাচার প্রতিবেদন : দুঃখিনী বর্ণমালা প্রবন্ধটি ধারাবাহিকভাবে বাংলার জনরব–এ প্রকাশিত হবে । তবে প্রতিবার শিরোনাম আলাদা থাকবে । মূল লেখাটি কংগ্রেস বার্তার শারদীয়া সংখ্যা থেকে নেওয়া হয়েছে । শুধুমাত্র শিরোনাম আলাদা হবে । আজ  চতুর্থ কিস্তি ।  প্রকাশিত অংশের পর —
মুর্শিদাবাদে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণ-ও উপরোক্ত ভাবনার এক অসামান্য ফসল । এই সমস্ত কিছুরই বিস্তারিত চালচিত্র ধরা আছে সেই সময়কার সরকারি প্রকাশনা ‘ সংখ্যালঘু উন্নয়নে আপনার পশ্চিমবঙ্গই দেশের সেরা ‘ শীর্ষক পুস্তিকায় । আর এই সবই সম্ভব হয়েছিল কেন্দ্রে ‘ সংখ্যালঘু বিষয়ক ‘ মন্ত্রক গঠন এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ছাত্র-ছাত্রী বৃত্তি , পেশাগত প্রশিক্ষণসহ এমএসডিপি
( MSDP) প্রকল্প রচনার মধ্যে দিয়ে । এই বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্পে ( MSDP) কেন্দ্রীয় বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে রাজ্যের ১২ টি জেলায় নানা ধরনের উন্নয়নের কাজ হয়েছে এবং আজও এই  সরকারের মূলধন । অথচ এই সরকার প্রতিনিয়ত অস্বীকার করে চলেছে । অবশ্য তা দুঃখিনী বর্ণমালা হয়ে জেগে আছে । আজও নানা প্রশ্নবাণে এই সরকারকে বিদ্ধ করতে চায় । তাই সময় এসেছে কী হয়েছিল আর কী হচ্ছে , নির্মোহ বিশ্লেষণে বস্তুনিষ্ঠভাবে তার হিসেব-নিকেশ মেলানোর পালার । রাজ্য সরকারের মূল্যায়নের এটাই  তো উপযুক্ত সময় ! কেননা ,রাজ্যের প্রায় ২৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী যদি উন্নয়নের সব ধরনের মানদন্ডে পশ্চাদপদ থেকে যায় , তাহলে সামগ্রিকভাবে রাজ্যের অগ্রগতি কী করে সম্ভব হবে ? সাম্প্রতিককালে প্রতীচি ট্রাস্ট-স্ন্যাপ গাইডেন্স-গিল্ড-এর করা  সমীক্ষাতেও সংখ্যালঘু মুসলিমদের দুর্দশার ছবিই স্পষ্টরূপে প্রতিফলিত হয়েছিল । নানা ধরনের ‘শ্রী‘ , ‘সাথী ‘ ‘ ভাতা ‘-আগেও ছিল, আজও আছে । নাম পরিবর্তনের ‘ শ্রী মাহাত্ম্য‘ অর্জন করেছে-এ যা ! আবার এই একই কাজ বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারও করে চলেছে । সাময়িকভাবে এই  সাহায্যগুলি সমাজের অন্যান্য অংশের সঙ্গে আপৎকালীন হিসাবে মুসলিমদের ক্ষেত্রে হয়তো সহায়ক হয়েছে ।
কিন্ত আমরা যদি সুষম সমাজ গড়ার কথা ভাবি , তাহলে এর উর্ধ্বে উঠে আমাদের ভাবতে হবে । চিরস্থায়ী সম্পদ সৃষ্টির কথা ভাবতে হবে । আর এই সবের প্রাক-শর্ত হল সম্প্রীতির অটুট মেলবন্ধন । তাই তো বলছি , এই সরকার তার দ্বিতীয় পর্বে মানুষের বিপুল জসমর্থন নিয়ে পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়েছে । কিন্ত এই ক্ষেত্রে বিশেষত্ববাহী নতুন ভাবনা-চিন্তার পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি । এই সরকারের প্রথম ৫ বছর ‘ তালে-গোলে ‘ কেটে গেছে । আপাত বিভাজনের রাজনীতিকে পুঁজি করে সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটের  একচেটিয়া অধিকার কিংবা হিন্দু সংহতির  উগ্র সাম্প্রদায়িক বচন ও  কাজ-কারবারের কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুত্ববাদী দলের থেকে তথাকথিত হিন্দু ভোটকে ভাগ করার একটা সুপরিকল্পিত প্রয়াস অবশ্যই রাজ্যে চলছে । বাঙালি ‘ শিবসেনা ‘ হওয়ার বাসনা থেকে এই ভোট ভাগের অঙ্কের বিষয়টি রাজনীতির নিয়মে সব সময় সহায়ক না-ও হতে পারে । হয়ও নি । বিগত লোকসভার নির্বাচনী ফলাফল তার সবথেকে বড় প্রমাণ । সভ্যতা বিনাশী , সর্বনাশী এই খেলায় প্রাথমিকভাবে সাফল্য পেলেও দীর্ঘমেয়াদে এর ভয়ঙ্কর রূপ রাজ্যবাসীকে আজ প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে । ধর্ম ও রাজনীতির এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা, অদ্ভূত বোঝাপড়া ; আপস-সমঝোতায় বাঙালির জীবনতরী প্রশাসনিকভাবে কোন খাতে বইবে তা অনাগত ভবিষ্যৎ-ই বলবে । আগামী  দু’বছর তাই এই সরকারের  অগ্নিপরীক্ষার কাল ! কারণ ত্রিপুরা তার জ্বলন্ত উদাহরণ ! প্রথমে কংগ্রেস থেকে দল ভাঙিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস , অতঃপর বিজেপি । আবার মানুষ কংগ্রেসের পতাকাতলে বিপুলভাবে সমবেত হচ্ছে । কংগ্রেস দ্বিতীয় শক্তি হিসাবে সেখানে উঠে এসেছে । তৃণমূল সমূলে নিশ্চিহ্ন হয়ে বিজেপিকে রাজ্যে ক্ষমতাসীন করে কী তাদের ঋণ পরিশোধ করেছিল ? এর জন্য ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হতে হয় না । বাংলার মানুষ এই বিষয়ে অধিকতর মাত্রায় সচেতন , এইটুকুই যা আশা !
সাচার কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-এর নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের  পক্ষ থেকে ’ প্রধানমন্ত্রীর নতুন ১৫ দফা কর্মসূচি ‘ও মুখ্যত দেশের ৯০টি জেলায় ( যেখানে ২০ শতাংশের অধিক সংখ্যালঘু মুসলিম জনসংখ্যার বসবাস ) বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প (MSDP ) গ্রহণ করা হয়েছিল । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , এই বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রেও ভারতের বড় রাজ্য গুলির মধ্যে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল প্রথম । শুধু তাই নয় , ইউপিএ নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার অমিতাভ কুন্ডুর নেতৃত্বে সম-সুযোগ কমিশন গঠন করার কথা সোচ্চারে ঘোষণা করেছিল । এও সত্য যে সংখ্যালঘু উন্নয়নে যাবতীয় কমিটি-কমিশন কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারই গঠন করেছে । বহুমুখী উন্নয়নমূলক কর্মসূচি ( ) , নানা ধরনের  বৃত্তি,, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রধানমন্ত্রীর নতুন ১৫ দফা কর্মসূচি সহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম কংগ্রেস সরকারই গ্রহণ করেছিল । সংখ্যালঘু উন্নয়নে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের প্রাণভোমরা তো এই সমস্ত কর্মসূচি । কংগ্রেস আমলে চালু করা এই সমস্ত কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলি নিয়েই এই সরকারের যত বাগাড়ম্বর ।
ইতোপূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে , সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা সর্বোপরি সংখ্যালঘুদের সার্বিক উন্নয়নকল্পে এই সরকার বিশেষ কোনও উদ্যোগী গ্রহণ করেননি বললেই চলে । আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউটাউনের ক্যাম্পাস , ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতা ও ধর্মীয় অনুষঙ্গযুক্ত ভাষার ও প্রতীকের ব্যবহার ছাড়া প্রায় সবই পূর্বতন সরকারগুলির প্রকল্প । মাদ্রাসা শিক্ষাকে এই সরকার তো প্রায় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছেন । সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের বিষয়টিকে সাচার প্রতিবেদন-এর সুপারিশ অনুযায়ী পূর্বতন সরকার পরবর্তী যে কাজ , তা তো হলই না ; শোনা যাচ্ছে বহু উন্নয়নমূলক প্রকল্প নাকি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । আসলে যে কাজগুলি তৃণমূল সরকারের করার কথা ছিল , সুকৌশলে, সযত্নে, ধর্মীয় জুজু দেখিয়ে তারা তা এড়িয়ে গেছেন । অবশ্য, এক্ষেত্রে রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত বিরোধী দলগুলির উদাসিনতাও সরকারের এই কাজে সহায়ক প্রতিপন্ন হয়েছে । এই উদাসিনতার দায়ভার রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত বিরোধী দলগুলি কী অস্বীকার করতে পারেন ? তারই পরিণতিতে হচ্ছে সংখ্যালঘু জনভিত্তিতে ক্রমশ সঙ্কোচন। ফলত , সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের বিষয়টি এখন কষ্ট কল্পনামাত্র ! এবার দেখা যাক , সাচার কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশকে মান্যতা-দান করে কী কী মৌলিক কাজ এই সরকারের করার কথা ছিল বা  করতে পারত অথচ রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে তা করা হল না । তা সূত্রাকারে নিম্নরূপ : –
এক . সম-সুযোগ ( ) : কমিশন গঠন : এই কমিশনের প্রতিবেদনে ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে । এটা জানা কথা যে , প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন আরএসএস-বিজেপির যুগলবন্দির এই সরকার সমসুযোগ কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করবেন না । হিন্দি, হিন্দু , হিন্দুত্বের আগ্রাসনে বলীয়ান এই  সরকারের সংখ্যালঘুদের প্রতি মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গির কথা সমগ্র ভারতবাসীর অজানা নয় । কিন্ত স্বঘোষিত ‘ মুসলিম দরদী ‘, ‘ তোষণের বাণীতে সোচ্চারে উচ্চকন্ঠ ‘ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের এই সুপারিশ রূপায়ণ করার ক্ষেত্রে বাধা কোথায় ? জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সরকারি সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সমান সুযোগের অধিকারী হবেন ।
দুই . রাজ্য পরিচালনায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের অংশীদারিত্ব কি বৃদ্ধি পেয়েছে ?
এক্ষেত্রেও কথার ফুলঝুরি , উল্লেখ্যযোগ্য কোনও অগ্রগতি হয়নি । যা হয়েছে তা অতি সামান্যই । সংখ্যালঘুদের মধ্যে এই প্রশ্ন বহুলভাবে আলোচিত হয়েছে যে , রাজ্য সরকারের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই অংশের মানুষের বা তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আদৌ কি কোনও উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা আছে ? সাতজনকে মন্ত্রী , প্রতিমন্ত্রী করা হলেও কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে , মাত্র একজন ছাড়া কারও নাকি কোনও কার্যকর ভূমিকা নেই । চারজনের কাছে নাকি কোনও সরকারি ফাইল যায় না । গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলিতে আরএসএস-এর মহামান্যরা ঠাঁই পেলেও মুসলিমরা পায় না।
এখন প্রশ্ন হল , রাজ্যের জনসংখ্যার সংখ্যানুপাতে সংশ্লিষ্ট  জনগোষ্ঠীর সরকারে প্রতিনিধিত্ব আছে কি না ? প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে , এই ক্ষেত্রে মুসলিমদের কোনও সংরক্ষণ নেই ।
দ্বিতীয়ত , স্বাধীনতার পর এই প্রথম জনসংখ্যার অধিক সংখ্যালঘু মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর দিনাজপুর , মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলায় কোনও পূর্ণমন্ত্রী নেই । আবার মালদা জেলায় প্রতিমন্ত্রী বা পূর্ণমন্ত্রী, কোনও ধরনের নেই । অথচ দল ভাঙানোর খেলায় তাদের চারজন বিধায়ক তো ছিলেন ! তাঁদের মধ্যে একজনও কি মন্ত্রী হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারলেন না ? তাই কি এত ‘ সংখ্যালঘু তোষণ ‘?
তৃতীয়ত , রাজ্য প্রশাসনাধীন বহু স্বশাসিত সংস্থা আছে । সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তরের অধীনস্থ স্বশাসিত সংস্থাগুলি ছাড়া অন্যান্য দপ্তরের স্বশাসিত সংস্থাগুলিতে কতজন সংখ্যালঘু মুসলিমকে  চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে ? তথ্য-সংস্কৃতি , শিক্ষা দপ্তরগুলির দিকে তাকালে মনে হয় , আজও সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে । কোথাও কোনও পরিবর্তন হয়নি । সংখ্যালঘু মুসলিমরা যে ‍তিমিরে ছিলেন ,সেই তিমিরেই নিমজ্জিত হয়ে আছে ।


Find Out More:

Related Articles: