ইরান আমেরিকা দুই কুল বজায় রাখতে ভারতের ভূমিকা কি হবে?
মার্কিন ড্রোন হানায় ইরানের সেনাকর্তা জেনারেল কাসেম সোলেমানি-সহ কয়েক জনের মৃত্যু ও তার প্রত্যাঘাতে ইরাকে মোতায়েন মার্কিন সেনা ঘাঁটির উপর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতের প্রেক্ষিতে ভারতের বিদেশমন্ত্রকের সামনে এখন অগ্নিপরীক্ষা।
কারন, শ্যাম রাখলে তো কূল রাখা যায় না। আবার কূল রাখতে গেলে যে শ্যাম থাকে না সঙ্গে! অথচ ভারতকে এখন শ্যাম আর কূল দু’টোই রাখতে হবে। একই সঙ্গে। নিজের স্বার্থে।
পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে মধুর থেকে মধুরতর হয়ে উঠেছে। আবার একই সঙ্গেইরান সহ মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টিকেও ভারত যথেষ্টই গুরুত্ব দিয়েছে। প্রতিরক্ষার মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও পেন্টাগন ও তেহরানের হাতে হাত রেখে চলে দিল্লি। তাই মার্কিন ড্রোন হানা ও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতের পর ভারত খুব স্বাভাবিক ভাবেই উদ্বিগ্ন। যাতে দু’দেশ অবিবেচকের মতো কোনও ঝটিতি সিদ্ধান্ত না নিয়ে বসে প্রকাশ্যে তার আবেদনও জানিয়েছে ভারত। কারণ, সেটা হলে আখেরে ভারতেরই ক্ষতি। ভারতের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। ফলে, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর কালবিলম্ব না করে কথা বলেছেন ইরানের বিদেশমন্ত্রী জাভাদ জারিফ ও মার্কিন বিদেশসচিব মাইক পম্পায়োর সঙ্গে।
অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিতে চিন এশিয়া-সহ প্রায় গোটা বিশ্বে একেবারে সামনে চলে আসায় তাকে ঠেকাতে অনেকগুলি দেশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলার ভাবনা ভাবতে হয়েছে আমেরিকাকে। সেই কাজে এগিয়ে যেতে কয়েকটি গণতান্ত্রিক দেশকে নিয়ে ‘লিগ’ বা সমমনস্ক জোট গড়ার পথে আমেরিকাকে হাঁটতে হয়েছে। তাই ভারতের মতো উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে ওঠা একটি গণতান্ত্রিক দেশকে পাশে পাওয়ার বড়ই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আমেরিকার। চিনের নাকের ডগার পড়শি হওয়ায় সেই জোটে ভারতের জায়গাটাও একেবারে সামনে। ভূমিকাটা যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের উপর আমেরিকার নজর পড়েছে দেখে মার্কিন-মিত্র বড় দেশগুলিরও ভারতকে নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে। ফলে, সেই সব দেশের সঙ্গে আমাদের হাই-টেক বাণিজ্য বেড়েছে। মহাকাশ গবেষণা ও পারমাণবিক শক্তিকে অসামরিক ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর নিত্যনতুন প্রযুক্তি আদানপ্রদানে সহযোগিতা সম্ভব হয়েছে।
এতে আমাদের উপকারই হয়েছে। পরমাণু অস্ত্র প্রসার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) সই না করার ফলে যে সব প্রযুক্তি হাতে পাওয়া অসম্ভব ছিল আমাদের, ঘুর-পথে সেই সব প্রযুক্তি ভারতের হাতে আসছে।
ইরানের ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়েছে। তেহরানের উচ্চাশা, পরমাণু অস্ত্রে স্বয়ম্ভর ও শক্তিশালী হয়ে ওঠা। কিন্তু এনপিটি-র শর্তগুলি তার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, মূলত পশ্চিমি দেশগুলির সম্মিলিত প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি কমিশন (আইএইএ) ইরানের বিতর্কিত পারমাণবিক কর্মসূচির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ভারতও সেই প্রস্তাবের শরিক ছিল। আমেরিকার সঙ্গে অসামরিক ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি সহযোগিতা চুক্তিতে সই করার ফলে এনপিটি-র শর্ত লঙ্ঘন করে তেহরানের পরমাণু অস্ত্রে শক্তিশালী হয়ে ওঠার উচ্চাশার বিরোধিতাই করতে হয়েছে দিল্লিকে।
ইরানের ওই উচ্চাশাকে দমন করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ভারত তার প্রতিবাদ করেনি জোরালো ভাবে। যা তেহরানের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়েছে। ইরানের তেল না পাওয়া গেলে অন্য রাস্তা ধরতে হবে ভেবে দিল্লি ওই সময় সৌদি আরবের দিকে ঝোঁকে। সেই সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যে দেশটি ইরানের ঘোর শত্রু বলেই পরিচিত। ফলে, ইরান তো বটেই গোটা বিশ্বেই এমন একটা সন্দেহ দেখা দেয়, ভারত কি আমেরিকার চাপের কাছেই মাথা নুইয়েছে? আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্বের যে বড় মূল্য চোকাতে হয়!
পরিস্থিতি পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধের সম্ভাবনা স্তিমিত হলেও এই মুহূর্তে ইরান সমস্যা মেটাতে কোনও এক বিশ্বাসযোগ্য তৃতীয় পক্ষের দৌত্যের আশু প্রয়োজন। ভারতের এখন সেই ভূমিকাই নেওয়া উচিত। এতে শুধুই মধ্যপ্রাচ্য বা গোটা বিশ্ব উপকৃত হবে তা নয়; একই সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতিতে ‘শান্তির কারিগর’ হিসাবে ভাবমূর্তি গড়ে তোলারও সুযোগ আসবে ভারতের সামনে।