বেলুড় মঠে রাজনৈতিক কায়দায় মোদীর সিএএ চাল
মূলত বেলুড় মঠের মঞ্চকে ব্যবহার করলেন মোদী, নতুন নাগরিকত্ব আইনের প্রচারের জন্য। বেলুড় মঠে রবিবার ৩৬তম জাতীয় যুব দিবসের অনুষ্ঠানে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) প্রসঙ্গ এনে মোদী বলেছেন, ‘‘নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার জন্য নয়। নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্যই এই সিএএ। আর এই সংশোধনী আইন নিয়ে সাধারণের মনে যে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে, তা দূর করার জন্য যুব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে।’’ এখানেই থামেননি মোদী। পুরোদস্তুর রাজনৈতিক সভার কায়দায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত যুব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের হাত তুলে মতামত জানাতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। অনেক পড়ুয়াই হাত তুলে তাঁকে সমর্থন করার পরে মোদী বলেন, ‘‘যে সহজ সত্যটা আপনারা অনেকেই বুঝছেন, তা রাজনীতির খেলোয়াড়েরা বুঝতে পারছেন না। আর যাঁরা বুঝছেন, তাঁরা না বোঝার ভান করছেন!’’ ওই অনুষ্ঠানেই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সাধারণ সম্পাদক স্বামী সুবীরানন্দ মোদীকে ‘দেশের অন্যতম সেরা প্রধানমন্ত্রী’ বলে অভিহিত করেন।
সিএএ প্রত্যাহার এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) বাতিলের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর সফর কালে দু’দিন ধরে বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে কলকাতা। ‘ধর্মীয় বিভাজনের আইন’ চালু করার পরে প্রধানমন্ত্রীর বেলুড় সফরের প্রতিবাদ জানিয়ে বেলুড় মঠ কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠিয়েছেন রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তনীরা। কিন্তু এ সবের পরেও মোদী নিজের অবস্থানই বজায় রেখেছেন। তাঁর মতে, স্বাধীনতার পরে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী-সহ অন্যান্য বড় বড় নেতা বলেছিলেন, যাঁদের উপরে ধর্মীয় কারণে পাকিস্তানে অত্যাচার হয়েছে, তাঁদের এ দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া উচিত। সিএএ নিয়ে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে জানার আগ্রহ থাকলেও তাঁদের অনেককেই ভুল বোঝানো হচ্ছে বলে অভিযোগ দাবি করেন মোদী। যুব সমাজের মন থেকে এই ‘ভ্রান্ত’ ধারণা কাটাতে ‘সঠিক’ তথ্য তুলে ধরার আহ্বান জানান তিনি। এমনকি, যুব সমাজকে সঠিক উত্তর দেওয়াটাও তাঁর কর্তব্য বলেও দাবি করেন তিনি।
স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে বেলুড় মঠের অনুষ্ঠানে মোদীর এমন বক্তব্য নিয়ে প্রশ্নই তুলেছেন রাজনৈতিক নেতারা। ধর্মতলার রাস্তায় প্রতিবাদের আসর থেকেই সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের অভিযোগ, বিক্ষোভের ভয়ে আকাশ ও জলপথ ব্যবহার করে এবং শেষ পর্যন্ত বেলুড় মঠের মতো ‘ঘেরাটোপ’ থেকে নিজের কথা বলে দিয়ে মোদী চলে গেলেন। সেলিমের কথায়, ‘‘উনি মানুষের ভাল হওয়ার কথা বলছেন। মানুষের ভাল করতে গেলে তো কর্মসংস্থান করতে হয়, অর্থনীতি চাঙ্গা করতে হয়, কালো টাকা ফেরাতে হয়, স্কুল-হাসপাতাল গড়তেও হয়!’’ তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘বেলুড় মঠের মতো জায়গায় প্রধানমন্ত্রী রাজনীতির কথা বলেছেন। বিনয়ের সঙ্গে বলছি, বিভ্রান্তি আপনারাই তৈরি করেছেন। ভোটের আগে থেকে বাংলা এবং নানা জায়গায় মোদী কী কী বলেছেন, সেগুলো মনে করে দেখলেই বোঝা যাবে।’’
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রেরও মত, ‘‘অনেক নেতাকে বেলুড় মঠে আসতে দেখেছি। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী অনেক বার এসেছেন। কিন্তু মোদীর মতো রাজনীতি করতে কাউকে দেখিনি! বেলুড় মঠে দাঁড়িয়ে যে ভাবে সিএএ-র অসত্য প্রচার করেছেন, সেটা প্রকারান্তরে স্বামী বিবেকানন্দের অপমান। গাঁধীজির কথাকেও বিকৃত করেছেন!’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ অবশ্য পাল্টা বলেছেন, ‘‘যাঁরা সব ব্যাপারে রাজনীতি খোঁজেন, এটা তাঁদের সমস্যা! আমাদের নয়। দেশে একটা আইন হয়েছে, সেটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে কোনও জায়গায় বলতেই পারেন।’’
মোদীর এ দিনের ভাষণের বিষয়ে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতিক্রিয়া অবশ্য সংক্ষিপ্ত। প্রবীণ সন্ন্যাসীরা বলছেন, ‘‘আমরা অনেক দিন ধরেই গেরুয়া বসন পরে রয়েছি। এই গেরুয়া রঙ ত্যাগ ও দেশাত্মবোধের প্রতীক। এর সঙ্গে রাজনীতির গেরুয়া রঙকে মেলানো কখনও ঠিক নয়।’’ আর স্বামী সুবীরানন্দের বক্তব্য, ‘‘বেলুড় মঠে নরেন্দ্র মোদী এসেছেন ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার মতো। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, আমাদের অতিথি। তিনি নিজে মঠে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তাই অতিথি সম্পর্কে কোনও নেতিবাচক মন্তব্য করা আয়োজক হিসেবে আমাদের উচিত নয়। এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি।’’ আর অনুষ্ঠানের মঞ্চে তিনি বলেন, ‘‘মোদী স্বামী বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণায় দেশের কাজ করে যাচ্ছেন। রাজভবনের রাজসুখ ছেড়ে তিনি বেলুড় মঠে থেকেছেন।’’
যুব সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বার্তা দিতে গিয়েই মোদী এ দিন সিএএ-র বিষয়ে ঢুকে যান। বলেন, ‘‘দেশে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে খুবই চর্চা চলছে। এটা নিয়ে আসা কি খুব জরুরি ছিল? ভারতের যুব সমাজ জাগ্রত। তাঁরা বুঝছেন, কেন এই সংশোধনী আনতে হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ কেউ বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন। ভুল ধারণার শিকার হচ্ছেন।’’ মোদী দাবি করেন, অন্য কোনও দেশের যে কোনও ধর্মের যে কোনও মানুষ যিনি ভারতের উপরে আস্থা রাখবেন, ভারতের সংবিধান মেনে চলবেন, তিনি ভারতের নাগরিকতা গ্রহণ করতে পারেন। এর মধ্যে কোনও বিরোধিতা নেই।