সত্যজিৎ রায়ের কিছু সিনেমা

A G Bengali
১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান সত্যজিৎ রায়। বিশ্ববরেণ্য পরিচালককে শ্রদ্ধা জানাতে আজ তাঁর কিছু সিনেমার কথা আলোচনা করব, যা বাঙালি কোনও দিন ভুলতে পারবে না। সত্যজিৎ রায় ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তবে সত্যজিতের সিনেমায় যেমন সমাজের কথা উঠে আসত তেমনি অনেক তথ্যও থাকত। সিনেমা দেখে যা জ্ঞান অর্জন করা যেত। এবার দেখে নেওয়া যাক কোন কোনসিনেমা বাঙালি হয়তো কোনও দিন ভুলতে পারবে না -


পথের পাঁচালী : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ‘পথের পাঁচালী’ সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট। এতে অভিনয় করেছেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, রুমকি বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। সত্যজিৎ রায়ের তিন পর্বে তৈরি অপুর কাহিনী পঞ্চাশের দশকে চলচ্চিত্র জগতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। শিশু অপুর বাল্যজীবন নিয়ে এর প্রথম খণ্ড পথের পাঁচালি ছিল সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি। পথের পাঁচালির পরবর্তী পর্ব ‘অপরাজিত’তে দেখানো হয়েছে বালক অপুর কিশোর হয়ে ওঠার কাহিনী। তৃতীয় ও শেষ পর্ব ‘অপুর সংসার’।
আজকের দিনে এ সিনেমাটিকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটি মনে করা হয়। এটি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ফিচার ফিল্ম ও ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ফিচার ফিল্ম বাংলাসহ ১৭টি দেশের আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়। সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ পুরস্কারটি।
ফেলুদা: না এটা কোনও সিনেমার নাম নয়, তবে ফেলুদা সিরিজ বাঙালি কি ভোলার চেষ্টা করলেও ভুলতে পারবে? বোধহয় না! প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদা সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসের সন্দেশ পত্রিকায় ফেলুদা সিরিজের প্রথম গল্প “ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি” প্রকাশিত হয়। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত এই সিরিজের মোট ৩৫টি সম্পূর্ণ ও চারটি অসম্পূর্ণ গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। ফেলুদার প্রধান সহকারী তাঁর খুড়তুতো ভাই তপেশরঞ্জন মিত্র ওরফে তোপসে ও লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি (ছদ্মনাম জটায়ু)। সত্যজিৎ রায় ফেলুদার সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথ উপন্যাসদুটিকে চলচ্চিত্রায়িত করেন। এই দুই ছবিতে কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
নায়ক: ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নায়ক গল্পের রচয়িতা সত্যজিৎ নিজেই। এ সিনেমার কাহিনি ও চিত্রনাট্যও সত্যজিৎ রায়ই রচনা করেছিলেন। লোকমুখে জানা যায়, এ কিংবদন্তি পরিচালকের সঙ্গে সর্বাধিক কাজ করা অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎকে জিজ্ঞাসা করলেন, নায়ক সিনেমাতে আমাকে নিলেন না কেন? সত্যজিৎ সৌমিত্রকে বলেছিলেন তুমি কি উত্তম! সত্যজিৎপুত্র চলচ্চিত্র নির্মাতা সন্দীপ রায় একটি সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, “বাবা উত্তম কুমারকে মাথায় রেখেই ‘নায়ক’ লেখেন। অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট। কোনও গল্প থেকে নেওয়া নয়।” সিনেমাটি ১৯৬৭ সালে শ্রেষ্ঠ বাংলা কাহিনিচিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে উত্তম কুমার এবং শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে সত্যজিৎ রায় বিএফজে পুরস্কার লাভ করেন। এতে নায়িকা ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর।
মহানগর : নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘অবতরণিকা’ গল্প অবলম্বনে ১৯৬৩ সালে ‘মহানগর’ নির্মাণ করেন সত্যজিৎ রায়। নগরায়নের ফলে ষাটের দশকে বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে সৃষ্ট নানা জটিলতা এবং তাদের মানসিক জগতের পরিবর্তন নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ছবিটি।
অশনি সংকেত: এই সিনেমাটি ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায়। ছবিটি নির্মিত হয়েছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে। এটি সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম রঙিন ছবি। ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ববিতা। অন্যান্য ভূমিকায় অভিনয় করেন সন্ধ্যা রায়, চিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। নাট্যাভিনেতা মৃত্যুঞ্জয় শীল অভিনীত প্রথম ছবিও এটি। ছবির মূল বিষয় ছিল তেতাল্লিশের মন্বন্তর এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ বাংলার আর্থ-সামাজিক পটপরিবর্তন। এ ছবিটি ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস গাইড টু দ্য বেস্ট ১,০০০ মুভিজ এভার মেড’ তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
হীরক রাজার দেশে: গুপি গায়েন বাঘা বায়েন সিরিজ বাঙালি কোনও দিন ভুলতে পারবে না। হীরক রাজার দেশে একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রের প্রতিটি চরিত্রই প্রতীকী। রাজসভার সবাই রাজার কথার সাথে সুর মেলায়। দেখানো হয় সামাজিক বৈষম্য। ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার বিপ্লবী চরিত্র হচ্ছে উদয়ন পণ্ডিত। উদয়ন পণ্ডিত হচ্ছে রাজার সবচেয়ে বড় শত্রু।
চারুলতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন ‘চারুলতা’ বা ‘দ্য লোনলি ওয়াইফ’। সামাজিক বেড়াজালের মধ্যে ‘চারুলতা’র এগিয়ে যাওয়াকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছবিতে।
অরণ্যের দিনরাত্রি: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ অবলম্বনে নির্মাণ করা হয়েছে এই সিনেমা। চারজন যুবককে নিয়ে তৈরি হয়েছে ছবির কাহিনী। শহরের বন্দিজীবন থেকে বের হয়ে চার বন্ধুর অরণ্যের আদিমতায় নিজেদের আবিষ্কারের গল্প এটা।
আগন্তুক: সত্যজিৎ রায়ের ক্যারিয়ারের সর্বশেষ ছবি ‘আগন্তুক’। হালকা মেজাজের চলচ্চিত্র এটি। ছবিটি সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন তার ছোটগল্প ‘অতিথি’ থেকে। ছবির প্রধান চরিত্র মনোমোহন মিত্র পুরো বিশ্বে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু তার বরাবরই পছন্দসই বন্য জীবন। সেই ঘুরে বাড়ানোর গল্প বাঙালি কোনও দিন ভুলতে পারবে না।

Find Out More:

Related Articles: