পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াকু জীবনের কথা

Biswas Riya

শৈশব থেকেই তাঁকে লড়াই চালাতে হয়েছে। নিজেকে মেলে ধরতে গিয়ে হাজারো বাধা পেরতে হয়েছে।সেই আত্মজীবনীর কথা তিনি শেয়ার করেছেন। তাঁর কথায়, ‘আমি রেওয়াজের মাঝপথে, ঠিক তখনই লোডশেডিং। তখনকার কলকাতার খুব চেনা ঘটনা। আমার মা সঙ্গে সঙ্গে ভিজে গামছা গায়ে দিয়ে বলল, ‘রেওয়াজ থামিও না। আমি আছি পাশে।’

আমার মা কাজলরেখা দেবী। মা বলত, ‘আমি তো আর পাঁচটা মায়ের মতো নই। তাই তুইও আর পাঁচটা ছেলের মতো তৈরি হবি না।’
সত্যিই আমার মা আর পাঁচটা মায়ের মতো নয়। জন্ম থেকেই দেখছি, আমার মা হাতে-পায়ে একসঙ্গে এগিয়ে চলে। ইংরেজি ওই ‘ডিজেবল’ শব্দটা মায়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলেও মায়ের মতো ‘এবল’ আলোকশক্তি তেমন করে আর চোখে পড়েনি আমার। মা আশৈশব পোলিও আক্রান্ত। তবুও এমন কাজ ছিল না, যা তিনি করেননি বা করতে পারেননি।

সঙ্গীত মাকে ঝড়বাদলের আঁধার পেরিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। আমার বাবা সম্মাননীয় সরকারি চাকুরে হলেও তখনকার দিনে দারুণ আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আমাদের ছিল না। মা সংসারের হাল ধরেছিলেন ভালবেসে। গান শেখাতেন। সুর দিতেন। বাড়িতে বিবিধভারতী চলত। সারা ক্ষণ গানবাজনা। ছাত্রছাত্রী ভরা সংসার। রেডিয়োয় মা নতুন গান শুনে মাটিতেই চক দিয়ে গানের কথা লিখে ফেলতেন। আমায় বলতেন, ‘সুরটা মনে রেখো’। এ ভাবেই মায়ের মধ্যে থেকে সুর ছন্দ লয় আমার দিকে এসে পড়েছিল।

 

মনে আছে, মা হাসপাতালে শুয়ে। এ রকম অবশ্য প্রায়ই হত। মা শারীরিক কারণে উনিশ বার হাসপাতালে গিয়েছেন। ভাঙা-গড়া এক জীবনে বাঁধা ছিল। একদিকে সঙ্গীত, সন্তান, সংসার। অন্য দিকে নিজের শরীর বার বার তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। মা চালিয়েছেন নিজেকে।

আইএস পরীক্ষা না দিয়ে সতেরো বছর বয়সে ন’মাসের জন্য বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলাম আমি। মা ছেড়ে দিলেন আমায়। মা বলতেন, ‘এ রকম মায়ের জন্য আমার কিছু হল না’, এই চিন্তা যেন কখনওই আমার পথ চলাকে আটকে না দেয়।
আগুনে পুড়েছেন আমার মা। আমাকেও পুড়তে শিখিয়েছেন। কোনও দিন ভাবেননি তার শারীরিক কোনও অসুবিধে আছে। একটা ট্রাই সাইকেল করে পৌঁছে যেতেন তাঁর ইপ্সিত গন্তব্যে। আমি সাইকেলটা পেছন থেকে ঠেলতাম। উনি হাত দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যেতেন। রাস্তায় আজও যে রকম দেখা যায়। মা যত না আমায় কোলে নিয়ে ঘুরেছেন তার চেয়ে মা-কে আমি অনেক বেশি কোলে তুলেছি। আজ ভাবলে কেমন অদ্ভুত লাগে!

মা সুচিত্রা মিত্রর কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখতেন। সুকৃতি সেনের কাছে নজরুলগীতি। আমিও সঙ্গে যেতাম। কান তৈরি সেখান থেকেই। আমিও সব গানের সঙ্গে বাজাতাম। মা সব ধারার গানের প্রতি ভাললাগা তৈরি করে দিয়েছিলেন। কখনও মনে হয়নি শুধু মার্গসঙ্গীতের স্তরই উচ্চ ধারার। প্রকৃতি, সময় বার বার মায়ের রাস্তা আটকেছে। মা ঠিক তাকে পেরিয়ে গিয়েছেন। কোনওদিন ভাবেননি তিনি অসহায়, সব কাজ পারবেন না।

মা যেমন রান্না করতে খুব ভালবাসতেন। এক বার রান্না করার সময় মায়ের ভাই পেছন থেকে মা-কে জড়িয়ে ধরলেন। হাতের ব্যালান্স রাখতে পারলেন না মা। সোজা গরম তেলের কড়ায় গিয়ে পড়লেন। চিকিৎসা হল। আগুনের কাছ থেকে আবার জীবনে ফিরলেন মা। এ রকম অজস্র ঘটনা আছে।

এই ফেরার গল্প যাতে সমাজের আর পাঁচটা মানুষের পায়ের নীচের মাটি শক্ত করে তার জন্যই মায়ের নামে আমার ‘কাজলরেখা মিউজিক ফাউন্ডেশন’ তৈরি করা। শারীরিক ভাবে অক্ষম অথচ গুণী মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার নিয়েই এই উদ্যোগ। এই সংস্থারও কুড়ি বছর হয়ে গেল। জাকির হুসেন জানতেন মায়ের কথা। উনি মায়ের যাত্রাকে সম্মানিত করতে এ বার হাত বাড়িয়ে দিলেন। ৭ জানুয়ারি সন্ধে ছ’টায় নজরুল মঞ্চে আমাদের ফাউন্ডেশনের জন্য, মায়ের জন্য উনি বাজাবেন।

সামনে থেকে না হোক, দিগন্তের কোনও এক আলোকরেখায় মা নিশ্চয়ই এই সন্ধ্যায় নিজের শরীরে রং মেখে নেবে’।

 

Find Out More:

Related Articles: