দেশমাতৃকাকে রক্ষা করার এক ছদ্মবেশী আহ্বান , বিদ্বেষকেও তারা পূজার অঙ্গ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে

Paramanik Akash
দেশজুড়ে বিজেপি-আরএসএসের তথাকথিত দেশভক্তদের উল্লাসে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী মানুষরা দিশেহারা । তবে আশার আলো হিসাবে দেখা দিয়েছে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভার ফলাফল । সাধারন মানুষ যে আরএসএস –বিজেপির কথিত দেশভক্তির চেয়ে রুটি-রুজির দিকে বেশি নজর দিতে চাইছে তার সংকেত হল এই নির্বাচনের ফলাফল । কিন্ত তা সত্ত্বে বলা যাবে না গেরুয়াপন্থীদের দাপট কমে গেছে , বরং বলা যেতে পারে তারা হোঁচট খেয়েছে মাত্র । তাদের আদর্শ ও নীতি এখনও জারি রয়েছে । কীভাবে এল হিন্দুত্বের শ্লোগান নিয়ে দেশের রাজনীতিতে আরএসএসের দাপট ? এর নেপথ্যে কোন কোন রাজনৈতিক দল গোপনে বা প্রকাশ্যে বিজেপিকে মদত দিয়েছে । আরএসএস-বিজেপির শিকড় কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে প্রবেশ করল তা নিয়ে কলম ধরেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ , রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারন সম্পাদক ড. আবদুস সাত্তার । বাংলার জনরব নিউজ পোর্টালে তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে । আজ দ্বিতীয় কিস্তি । প্রকাশিত অংশের পর …
২০১৯ – এর লোকসভা নির্বাচনী জয়ের লেলিহান শিখা সংকীর্ণ সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের পথ ধরে অন্ধ প্রমত্ত হয়ে উঠতে চাইছে । শিশুঘাতী , নারীঘাতী সবশেষে ভ্রাতৃঘাতী রূপ ধরে অগ্রসর হওয়ার লক্ষ্যে দ্রূত পদক্ষেপে চলেছে । বহুত্ববাদী ভাবনার  দলন শুরু হয়েছে । ইতিহাসকে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের নামাবলী পরিয়ে গাথা-মহাগাথার নির্মাণযজ্ঞ চলছে । রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও কল্যাণে এই কাজ আরো দ্রূতগতিতে ধাববান । শক্তির মদমত্ততায় এর আস্ফালন তাই আজ বহুগ্রাসী । বহুরূপে , বহুভাবে আজ তার বহিঃপ্রকাশ । একমাত্রিক পরিচয়- এর নিগড়ে দেশবাসীকে নিবন্ধ করা । অতপরঃ কি , এক ধর্ম , এক জাতি , এক সংস্কৃতি , এক ভাষা ? অনাগত ভবিষ্যতে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের জাতীয়তাবাদের গর্ভে কি সব লীন হয়ে যাবে ? বহু ধর্ম , বহু ভাষা ,  বহু সংস্কৃতির আধার , বৈচিত্র্য সম্পন্ন ঐক্যের এই পরিবেশ কি ধূলায় লুণ্ঠিত হয়ে যাবে ? বন্দেমাতরম , গো-সংরক্ষণ , সূর্য নমস্কারের তুলনা , শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে পোশাক-বিধি , যোগাভ্যাসের বাধ্যতামূলক প্রবর্তন , রাম-নবমীতে অস্ত্র প্রদর্শন – এই সমস্ত বিষয়গুলি আজ ছদ্মবেশে দেশপ্রেম , সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের আকর হিসাবে দেশবাসীর সামনে হাজির করা হচ্ছে । নয়ের দশকের রামমন্দির নির্মাণ-পর্বের উগ্রতা হয়তো এর মধ্যে নেই কিন্ত আছে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করার এক ছদ্মবেশী আহ্বান । বিদ্বেষকেও তারা পূজার অঙ্গ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে । এই আহ্বানে বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষিত সংস্কৃতিপ্রেমীরাও নানাভাবে জেনে না জেনে আক্রান্ত হচ্ছেন। কল্পিত সৃষ্ট এই পরিবেশে যুক্তি ,বুদ্ধি দিয়ে বিচার-বিবেচনা নয় , সমাজের বৃহদংশ কোনো উগ্র তাড়ানার পেছনে ছুটে চলেছে ।  এর মূলে রয়েছে পারস্পরিক অবিশ্বাস , বিশেষত মুসলিম বিদ্বেষ ।
অস্থির পরিবেশ , অস্থির অর্থনীতি সৃষ্ট যান্ত্রিক বাতাবরণের ঘুর্ণায়মান স্রোতে সব যেন কেমন ঘুলিয়ে যেতে শুরু করেছে । কোথাও দু’দন্ড শান্তিতে জিরিয়ে নিতে দেয় না । সকলের তরে সকলের ভাবনাটা নয় , আমার গ্রাস অবঞ্ছিত অন্যেরা কেড়ে খায় , তাদের জন্যই আমাদের আজো এই দূর্দশার ধ্বংসযজ্ঞের পাঠ  নানাভাবে , নানা রূপে উচ্চারিত হয়ে কান ঝালাপালা করতে থাকে। পরিণতিতে বিদ্বেষ  সর্বগ্রাসী হতে চায় । ছোটো ছোটোদের হাতে শিশুপাঠ্য বই নয় , আমদানি করা  খাপ খোলা তালোয়ার হয়ে ওঠে বিদ্বেষের সামরিক প্রতীক , সমরচিত্র । সুকুমার কোমল-মতি এই সমস্ত কচিকাঁচাদের কেন , কী কারণে  এই রণসাজে  সজ্জিত করা হচ্ছে ? ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা একটি বিশেষ দলের নেতারাই বা কেন অস্ত্র প্রদর্শনে মরিয়া হয়ে উঠলেন ?  ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিক্ষা , স্বাস্থ্য , বাসস্থান , কর্মসংস্থান সর্বোপরি মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের লড়াইয়ের উপর কি এদের কোনো ভরসা নেই ? এই কি তব ধর্ম ? এই কি তব রাজনীতির ক্ষমতায়ন ? শত  সহস্র শহীদের স্বপ্ন , আকাঙ্খা মৃত্যু কি তব নিস্ফলের প্রার্থনা হয়ে থেকে যাবে ?
হিন্দুত্ববাদী দেশভক্তদের অস্তির পদচারনায় বাংলার মানুষ আজ চিন্তিত । ১৭৭৫ সালে জনসন কৃত একটি আপ্তবাক্য এক্ষেত্রে আমাদের সহায় হতে পারে – ‘ দেশভক্তি হচ্ছে নীতিহীনদের শেষ আশ্রয় ‘। এই আপ্তবাক্যে অনেকেই হয়তো অবাক হতে পারেন । কিন্ত কোন পরিবেশ, কোন প্রেক্ষিতে তিনি কথাটি বলেছিলেন  তা আমাদের  জানা নেই । তবে একথা নিঃসশয়ে বলা যায় যে ,  সকলের দেশভক্তি নিয়ে তিনি  নিশ্চয় প্রশ্ন তুলতে চাননি , এখানেও তার কোনো অবকাশ নেই । কিন্ত মিথ্যা , সাজানো দেশভক্তি এবং দেশভক্তদের লক্ষ্য করেই হয়তো তাঁর এই কথন । আবার এই কথন , উচ্চারণ আজ আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে যখন দেখি কেন্দ্র ও বহু রাজ্যের শাসকদলের নেতা-মন্ত্রী-কর্মিরা জনসন কথিত দেশভক্তদের মতো আচরণ করে চলেছেন । পুঁজি পোষিত ‘ জাতীয়তাবাদী ’ সংবাদমাধ্যম বিশেষত বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের প্রধান সঞ্চালক , সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় –উত্তর সম্পাদকীয় কিংবা ক্ষমতার বৃত্তে , বাইরে থাকা  সমাজের ‘ বিশিষ্টজন ‘ –রূপে খ্যতানামাগণ অথবা সেনানী- সব মিলিয়ে বর্তমান ভারতের ক্ষমতার করিডরে স্বঘোষিত দেশভক্তদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে । স্বদেশীয়ানা’র দিনগুলিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ ঘরে –বাইরে ‘ উপন্যাসে বিমলার কথনের মধ্যে দিয়ে নিখিলেশের যে মনোভাব ব্যক্ত করেছেন , তা আজ ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক । কবিগুরু’র মনোভাব –ও তাতে ধরা পড়ে – ‘ অথচ স্বদেশী কান্ডের সঙ্গে যে আমার স্বামীর যোগ ছিল না বা তিনি এর বিরুদ্ধে ছিলেন তা নয় । কিন্ত ‘ বন্দেমাতরম ‘ মন্ত্রটি তিনি চূড়ান্ত করে গ্রহণ করতে পারেননি । তিনি বলতেন , ‘‘ দেশকে আমি সেবা করতে রাজি আছি , কিন্ত বন্দনা করব যাঁকে তিনি ওর চেয়ে অনেক উপরে । দেশকে যদি বন্দনা করি তবে দেশের সর্বনাশ করা হবে । “ তাই  ‘ আমি প্রদীপ  জ্বালাবার হাজার ঝন্ঝাট পোয়াতে রাজি আছি , কিন্ত তাড়াতাড়ি সুবিধের জন্য ঘরে আগুন লাগাতে রাজি নই । ওটা দেখতেই বাহাদুরি , কিন্ত আসলে দূর্বলতার গোঁজামিলন ’।


Find Out More:

Related Articles: